চন্দ্রকথন!


চাঁদ তো সব সময়ই দেখি। কিন্তু ঈদ এর চাঁদ? ওটা বছরে দু'বারই দেখা যায়। যদিও ওই চাঁদের আলাদা কোন চেহারা থাকে না কিংবা থাকে না তার গায়ে কোন লেখাজোখা। তবু সে নিয়ে আসে আনন্দ আর উল্লাস ভরা ঈদের খুশি। প্রাণে প্রাণে দিয়ে যায় দোলা। তাই তো ঈদের চাঁদ দেখার জন্য রমজানের শেষ দিনে সন্ধাবেলা ছেলে-বুড়ো সবাই জড়ো হয় খেলার মাঠে কিংবা বাড়ির ছাদে। চাঁদ দেখার আনন্দটা ছোটদেরই বেশি। আজ চাঁদ দেখা মানে আগামীকাল ঈদ। কি যে আনন্দ!

ঈদ মানে উৎসব। চারিদিকে হল্লা করে উৎসবের জোয়ার। হাটে-মাঠে-ঘাঠে, গ্রামে-গঞ্জে সবখানে যেন বাতাসের কানে কানে গুনগুনিয়ে বাজে খুশির বার্তা। এই খুশির বার্তা নিয়ে আসে কে? চাঁদ। এক ফালি চাঁদ। একখানি বাঁকা চাঁদ।

রমজান মাস সিয়াম সাধনার মাস। এটি চাঁদের মাস বা আরবি মাস। এটা চাঁদের মাস বা আরবি মাস। আরবি ক্যালেন্ডার চাঁদের উপর নির্ভর করে চলে। অর্থাৎ চাঁদ উঠলেই পরের মাস শুরু এবং পরবর্তী চাঁদ উঠলেই একটা মাস শেষ অন্য মাসের শুরু। সারা বছর আমরা চাঁদ উঠা দেখার জন্য অপেক্ষা না করলেও শাওয়ালের চাঁদ দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি। কারণ শাওয়ালের চাঁদ মানেই তো উৎসব- শাওয়ালের চাঁদ মানেই তো আনন্দ। শাওয়ালের চাঁদ মানেই তো ঈদুল ফিতর। আর ওই চাঁদ উঠলেই তো পৃথিবী ধ্বনিত হয় নজরুলের সুর, 'রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ'।

আমাদের এই পৃথিবীটার বাড়ির কাছের প্রতিবেশী চাঁদ। তার হাঁটাচলাও আমাদের এই পৃথিবীকে ঘিরে। তাই সে আমাদের এই পৃথিবীর উপগ্রহ। তাকে আমরা সব সময় দেখি। অবশ্য মাঝে মাঝে দু’ একদিনের জন্য সে হারিয়ে যায়। আর তার এই হারিয়ে যাওয়ার পিছনে কারণও আছে। যখন সে পরিপূর্ণ আকার নিয়ে রাতের আকশে উঠে তখন তাকে বলে পূর্ণিমা। পূর্ণিমার পরদিন থেকে চাঁদ ক্ষয় হতে থাকে আর মাসের শেষ দুই-তিনদিন সে হারিয়ে যায়। লুকিয়ে থাকে আমাদের ছেড়ে। তারপর একদিন সন্ধ্যাবেলা আবার তাকে দেখা যায়। সে ওঠে বাঁকা কাস্তের মতো কিংবা ধনুকের আকার নিয়ে। আস্তে আস্তে বাড়তে বাড়তে পনের দিনের দিন সে পা দেয় পূর্ণিমায়। চাঁদের এই বেড়ে ওঠাকে বলে শুক্লপক্ষ আর ক্ষয় হয়ে যাওয়াকে বলে কৃষ্ণপক্ষ।

চাঁদের বুকে মানুষের পা পড়েছে অনেকদিন হলো। তবু শেষ নেই চাঁদের রহস্যের। তাকে নিয়ে দেশে দেশে প্রচলিত আছে নানা লোককাহিনী আর রূপকথা। কোন কোন ধর্মে চাঁদকে দেবতা মনে করে পূজাও করা হয়। তবে চাঁদকে নিয়ে যাই করুক না কেন চাঁদ চাঁদই। ও নিয়মিত আকাশে ওঠে, আলো দেয়। যদিও তার নিজের কোন আলো নেই। সূর্যের থেকে আলো নিয়ে সে আমাদের দেয়। সে অর্থে চাঁদকে আমরা মহৎও বলতে পারি। কারণ দিনের সূর্য হারিয়ে গেলে সে আমাদের আলো দেয়। আর আলোর বিনিময়ে সে আমাদের কাছে কিছুই চায় না।

ঈদের চাঁদ শুধু আনন্দের নয়। এই চাঁদকে নিয়ে গ্রাম বাংলায় ছড়িয়ে আছে সংস্কারও। আগের দিনের বয়স্ক মানুষেরা ঈদের চাঁদ দেখে বলে দিতে পারত এ বছর বাজারদর কেমন যাবে, ফসল ফলবে কেমন, বন্যা কিংবা খরা হবে কিনা।  বিষয়টি হেসে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। কারণ এর সাথে জড়িয়ে ছিল তাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। তাছাড়া চাঁদের সাথে আমাদের পৃথিবীর কোন কিছু্ই যে নড়াচড়া করে না তাও কিন্তু নয়। সাগরে নিয়মিত জোয়ার-ভাটা হয় চাঁদের প্রভাবই। চাঁদ জড়িয়ে আছে মানব সমাজের সাথে, জড়িয়ে আছে পৃথিবীর তাবৎ সাহিত্য, সংস্কৃতি আর সঙ্গীতের সঙ্গে। মুসলমানদের ঈদ শুধু নয়, হিন্দু-বৌদ্ধসহ অন্যান্য ধর্মের উৎসব আনন্দও চাঁদের গণনার ওপরই নির্ভরশীল।

চাঁদ আমাদের সভ্যতার একটি অংশ। তাকে ছাড়া আমাদের উৎসব নয়, আনন্দ নয়। তাকে ছাড়া নয় আমদের প্রেম, আবেগ-অভিমান কিংবা অনুরাগ। কেননা আমাদের যাবতীয় রোমান্স আর বিরহের সঙ্গী তো ওই চাঁদ-ই।



সূত্র: সমকাল

Comments

Popular posts from this blog

Lukochuri: A Traditional Game of Bangladesh

বাংলাদেশের জাতীয় পাখি দোয়েল

মানুষের তৈরি প্রথম নভোযান