কুস্তির নাম সুমো


সুমো জাপানিদের অত্যন্ত জনপ্রিয় এক খেলা। এটি পৃথিবীর প্রাচীন খেলাগুলোর একটি যার উদ্ভব সপ্তম খ্রিস্টাব্দে। এটি শুধু খেলাই নয়, এর সাথে জড়িত নানা সংস্কার ও ধর্মীয় চিন্তাধারা। জাপানিদের বিশ্বাস সুমো খেলা আয়োজন করা হলে বেশি বেশি ফসল জন্মে। সুমো খেলোয়াড়রা ধর্মীয় ও সামাজিক দিক থেকেও বেশ সম্মানিত ব্যক্তি। আর চাকরির ক্ষেত্রেও সুমোয় পারদর্শিতা বিশেষ গুণ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই সুমো অ্যাসোসিয়েশন প্রতি বছরই বিশাল উৎসবের মধ্য দিয়ে সুমো খেলার আয়োজন করে।

প্রতিবার দু’জন প্রতিযোগী খেলায় অংশগ্রহণ করে। এদের রিকিশি বলা হয়। আর প্রতি বছর ছয়টি গ্রান্ড টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। এ টুর্নামেন্টগুলো জানুয়ারী, মে ও সেপ্টেম্বর মাসে টোকিওতে এবং একটি করে ওসাকা (মার্চ), নাগোয়া (জুলাই) ও ফকয়োকায় (নভেম্বর) অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি টুর্নামেন্ট রোববারে শুরু হয় এবং শেষও হয় রোববারে। আর ১৫ দিন ধরে চলে এই খেলা। যে সবচেয়ে বেশি খেলায় জেতে সেই হয় গ্রান্ড চ্যাম্পিয়ন বা ইয়োকোজুনা। তার জন্য রয়েছে বিপুল সম্মান ও অঢেল পুরস্কার।

খেলার জায়গাটিকে দোহিও বলা হয়। দোহিওর ব্যাস হয় ১৫ ফুট। এটি মাটি ও বালুর সংমিশ্রণে তৈরি হয়। জায়গাটিকে তারা অনেক পবিত্র স্থান বলে মনে করে। তাই প্রতিটি ম্যাচের শুরুতে লবণ ছিটিয়ে স্থানটিকে পবিত্র করে নেওয়া হয়। প্রতিপক্ষকে ঠেলে, গুঁতিয়ে, ডিগবাজি দিয়ে ফেলে কিংবা দোহিও থেকে বের করে দিতে পারলেই জয় নিশ্চিত। তবে কেউ ঘুসি মারলেই সে ডিসকোয়ালিফাইড বা অযোগ্য। প্রায় খেলা মাত্র কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয়। অবশ্য মাঝে মাঝে তা কয়েক মিনিটে গড়ায়। বিশাল দেহ ও স্বল্প পোশাকের কারণে রিকিশি বা সুমো খেলোয়াড়দের খুব সহজেই চেনা যায়।

উদোম শরীরে মোটা সিল্কের বেল্ট বিশেষভাবে কোমরে বাঁধা থাকে। এই বেল্টের নাম মাওয়াশি। মাওয়াশির সাথে এক টুকরো কাপড় জুড়ে দিয়ে লজ্জাস্থান ঢাকার ব্যবস্থা। সম্ভবত এত স্বল্প পোশাক পৃথিবীর আর কোন খেলায়ই নেই। আর মাথার লম্বা চুল ঝুটির মতো বাধা থাকে। খেলা পরিচালনার জন্য থাকেন একজন গিয়োজি (রেফারি)। খেলায় জয়-পরাজয় নির্ধারণ ও ক্লান্ত হয়ে পড়া খেলোয়ারকে উৎসাহ দেওয়ার তার কাজ। তার পরনে থাকে রাজকীয় পোশাক। আর ১৬৮০ সাল পর্যন্ত এ খেলার বিভিন্ন নিয়ম ছিল। কিন্তু ১৬৮০-এর পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত এ নিয়মটিই চলে আসছে।

সুমো খেলা বিশেষ সাধনার ব্যাপার। ধৈর্যের সাথে কেবল খাওয়া, ঘুম ও অনুশীলন- এই তিনের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে হয়। প্রত্যহ নিয়মমতো চলে ব্যায়াম, অনুশীলন ও যোগাসন। রিকিশিরা সকালে নাস্তা না করে দুপুরে প্রচুর পরিমাণে খায়। এদের খাবারের তালিকায় রয়েছে মাছ, মাংস, সবজি, বিয়ার ইত্যাদি। তারপর আবারো ঘুম। শরীরের ওজনের উপর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আর ওজনদার শরীর ধরাশায়ী করা কঠিন। তাই সুমোরা ইচ্ছেমত নিজেদের ওজন বাড়িয়ে থাকে। যদিও কৌশলে কম ওজনধারী রিকিশি অধিক ওজনধারীকেও কুপোকাত করতে পারে। সাধারণত ১৫ বছর থেকে শুরু করে ৩০ বছর পর্যন্ত এই খেলা খেলা যায়। অবসর গ্রহণের পর কেউ সুমো প্রশিক্ষক বা অন্য কোন কাজে নিয়োজিত হয়। বর্তমানে জাপানে প্রায় ৭০০ প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য ৫৪টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা হিয়া রয়েছে।

সুমো যোদ্ধারা শৃঙ্খলাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করে। আর জাপানিদের ‘শিন্তো’ ধর্মের মূল কথাও নিয়ন্ত্রিত জীবন। তাই পবিত্রতা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় বিজয়ী কখনো বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে না। এই কারণে নারীদের দোহিওতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। তাই কোন নারী কুস্তিগীর বা প্রশিক্ষক নেই।

বিশ্বব্যাপী সুমোর প্রসারের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সুমো ফেডারেশন কাজ করে যাচ্ছে। ফেডারেশনের মূল লক্ষ্য অলিম্পিকে সুমো খেলার অন্তর্ভুক্তি। আর এসব বিচারে সুমো খেলা জাপানিদের কাছে ধর্ম পালনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।

Comments

Popular posts from this blog

Lukochuri: A Traditional Game of Bangladesh

বাংলাদেশের জাতীয় পাখি দোয়েল

মানুষের তৈরি প্রথম নভোযান